করোনায় আতঙ্কিত যখন বিশ্ব, কয়রায় স্বাভাবিক তখন গ্রামীন  জনজীবন

0
597
ওবায়দুল কবির(সম্রাট):-কয়রা :-
বালু ভরা গ্রামের রাস্তায় দেখা মিলল কিছু কৃষাণ-কৃষাণীর। তাদের বেশিভাগের মুখে মাস্ক নেই। হাতে নেই সুরক্ষার  গ্লাভস।নেই কোন দুরত্ব।  তবে কাস্তে, কোদাল ঠিকই রয়েছে সঙ্গে। কাজ করতে চলে মাঠে। দূরে চোখে পড়ল আরও কিছু নারী-পুরুষকে। তারা মাঠে ব্যস্ত কৃষি কাজে। আবাদি জমির পরিচর্যায় ঘাম ঝরা রোদে ক্লান্তিহীন পরিশ্রমরত।সাথে আছে কিছু মুন্ডা সাম্প্রদায়ের মানুষ।অপর দিকে সকালের কাঁচা বাজার দোকান গুলোতেও ভিড় চোখে পড়ার মতো।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খুলনার কয়রা উপজেলার বিভিন্ন স্থানের ঘুরে এমন চিত্রের দেখা মিলেছে।বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় উপজেলা কয়রা অঞ্চলের শ্রমজীবী এসব মানুষের মধ্যে নেই করোনা আতঙ্ক। তাদের চোখে মুখে ফসল বাঁচানোর চিন্তা।পেটে আহার দেওয়ার চিন্তা। এদের কেউ কেউ কৃষি শ্রমিক। অন্যের জমিতে কাজ করলেই চুলোয় ওঠে ভাতের হাঁড়ি। তাই করোনা সংক্রমণ নিয়ে এরা চিন্তিত নয়। করোনা কি তাও তারা জানেন না। এদের কপালে চিন্তার ভাজ দু’মুঠো ভাতের যোগান নিয়ে। বাকী ভরসা আল্লাহ উপর।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়ির বাইরে বিভিন্ন পুকুর কাটার চলছে ধুম,  বাড়ি সংস্কার ও মাঠে মাঠে কাজকাম।গ্রামের কেউ বা মোড়ে মোড়ে খেলছে তাস, ও লুডু। গ্রামের মোড়ে মোড়ে  জনসমাগম করে দেখছে চায়ের দোকানে  টেলিভিশন।গণমাধ্যম কর্মিদের দেখা প্রশাসন ও গণমাধ্যম কর্মিদের দেখলেই দোড়।  গ্রামের অধিকাংশ বাজারগুলোতে দোকান সব খোলা। উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশের সামাজিক নিরাপদ দুরত্ব নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমান আদালত ও টহল অব্যাহত রয়েছে। টহল পরিচালনা করার পর পর ই গ্রাম গুলোতে আবার স্বাভাবিক।
এলাকাবাসি সাথে কথা বলে জানা গেছে, সচেতনতার অভাবের চেয়ে এখানকার অসহায়, দুস্থ ও শ্রমজীবী মানুষের পেটের ক্ষুধা মেটানোর অভাবটা একটু বেশি। পুলিশ প্রশাসন সারাক্ষণ সচেতন করলেও জনগণকে  আটকাতে পারছে না। তাছাড়া তাঁদের ধর্মের প্রতি অন্ধবিশ্বাস। এখন যদি করোনাভাইরাসের ভয়ে হ্যান্ডশেক না করে অথবা ঘরে বসে কেউ থাকেন, এটা তাঁদের ইমানের প্রশ্নে সন্দেহের জন্ম দেবে। আর কোনোভাবেই ইমান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেওয়ার মতো মানুষ গ্রামে খুব একটা নেই। ইমান আর কুসংস্কারের মধ্যে অনেকেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। ছোটবেলা থেকে যা দেখেছেন, শুনেছেন, বেশির ভাগ গ্রামের মানুষ সত্যতা যাচাই না করেই ধর্মীয় বিধিনিষেধ হিসেবে মেনে নিয়েছেন, পৃথিবীর খারাপ সময়েও তাঁরা সেভাবেই চিন্তা করছেন। এই চিন্তাভাবনা গ্রামে বয়ে নিয়ে আসতে পারে ভয়াবহ দুর্যোগ।
এলাকার বাসিন্দা কামাল, ইউসুফ ও গোলামসহ গ্রামের যুবকদের সাথে করোনার ভয়াবহতা নিয়ে কথা হয়। তারা এক কথায় উত্তর দেন, ‘আল্লাহই ভরসা।’কয়রা উপজেলা সদরে কথা হয়  মুন্ডা সাম্প্রদায়ের আদিবাসী মহিলা  দিন মজুর বিষপতির করোনার কথা শুনতেই বললেন, ‘হামার এত্তি বিদেশি অসুক (রোগ/ভাইরাস) আইসপার নয়। হামরা কামলা দিয়া খাই। ঘরোত থাকলে পেট চলবে কেমন করি। কায়ো তো খাবার ব্যবস্থা করি দিলে না। ওই করোনা ওগের ( রোগের) চ্যায়া প্যাটের ভোক (ক্ষুধা) বেশি ভয়ংকর ।
’খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের স্বাধীন সমাজকল্যাণ যুব সংস্থার সভাপতি মোঃ আবু সাঈদ খান বলেন, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই গ্রামে বাস করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা আতঙ্ক নিয়ে সম্প্রতি শহর  ও ইট ভাটা ছেড়ে বাড়ি ফেরা মানুষগুলো। ফলে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি শহরের চেয়ে কোনো অংশে কম নেই গ্রামে। যদিও সচেতনতায় সবচেয়ে উপেক্ষিত রয়েছে গ্রামাঞ্চল। গ্রামাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সচেতনতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘শহরের মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে যে ধরনের সচেতনতা রয়েছে, গ্রামে এর ছিটেফোঁটাও নেই। এলাকার হাট-বাজার ও চায়ের দোকানগুলো খুব জমজমাট। উদ্যোগ নিয়েও সচেতনতা বাড়ানো যাচ্ছে না বলে দাবি করে  তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের মানুষের সচেতনতার মাত্রা খুবই খারাপ। মাইকিং ও লিফলেট বিতরণসহ নানা উদ্যোগ নিয়েও এখানকার মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না।’
শিক্ষক সাইদুর রহমান বলেন , গ্রামের অধিকাংশ মানুষ করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অজ্ঞ। দুর দরন্ত থেকে শ্রমিক আসছে এলাকায়  সরকারের স্বাস্থ্য বিধি কিছুই মানছে না। যদি তাদের সচেতন হতে বলেন, দিনে কয়েকবার হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান দিয়ে হাত ধুতে বলেন অথবা মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে বলেন, তাঁদের উত্তরটা অনেকাংশেই গোঁড়ামিতে ভরা থাকে। তাঁরা ধর্মের ব্যাপারটি টেনে আনেন। সম্ভবত লাশের স্তূপ না দেখা পর্যন্ত তাঁরা বুঝতে চাইবেন না।মসজিদে করোনা প্রতিরোধে মসজিদে  ৫ নির্দেশনা অমান্যকরে অধিকাংক গ্রাম গুলোর মসজিদে  অনেক মানুষ দেখা যাচ্ছে।
শরিফুল আলম বলেন, প্রশাসনের ঘোষনা পরও সড়কে অবৈধ ট্রলি, ইজি বাইক অবাধে চলাচল করছে। এতে স্থানীয়দের করোনা ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার আগেই তাদের খাদ্য নিশ্চিত করে চলাফেরা বন্ধ করে দিতে হবে।কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আ,ব,ম আব্দুল মালেক বলেন, ‘দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ করোনা তো বোঝেই না, স্বাস্থ্য সচেতনও নয়। খেটে খাওয়া মানুষজন জীবিকার তাগিদে কাজে ছুটছেন। এখানে চলাফেরাতেও নেই কোনো সীমাবদ্ধতা। এসব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে করোনা সংক্রমণ রোধে সঙ্গরোধ বা সামাজিক দূরত্বও নিশ্চিত হবে। তাহলেই ঝুঁকিমুক্ত থাকবে গ্রামের মানুষও।’
কয়রা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ রবিউল হোসেন বলেন, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কয়রা থানা পুলিশ। প্রয়োজন ছাড়া যারা বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন তাদের ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকলকে বাড়িতে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।এছাড়া উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহে চেক পোষ্ট বসিয়ে মানুষের ঘরে ফেরানো কার্যক্রম জোড়দার করাসহ নিয়মিত টহল অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিমুল কুমার সাহা বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।
ওষুধের দোকান, শিশুখাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানপাট নির্ধারিত সময়ে চালু রাখাসহ অন্য সকল দোকানপাট বন্ধ রাখা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় নিশ্চিত করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।এসব বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।গণ পরিবহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায়  ও সেনা টহল অব্যাহত আছে।