ওষুধ কোম্পানি বনাম মাফিয়া

0
324

খুলনাটাইমস স্বাস্থ্য: “ওষুধ কোম্পানি আর মাফিয়ার সঙ্গে যে মিল দেখা যায় তা ভয়াবহ। ওষুধ কোম্পানি সীমাহীন অর্থ আয় করে, যেমন কামাই করে মাফিয়ার লোকজন। মাফিয়ার কর্মকা-ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মানুষ মারা যায়, খুন হয়। একই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। মাফিয়া রাজনীতিবিদসহ অন্যান্যের পয়সার বিনিময়ে কিনে ফেলে। একই কাজ করে ওষুধ কোম্পানি।”
কথাগুলো ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যালসের এক সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্টের।
আপনি যদি মনে করে থাকেন যে, ওষুধ কোম্পানিগুলো আপনার সুস্বাস্থ্যকে তাদের ধ্যানজ্ঞান করে বসে আছেন, সম্ভবত আপনার এখন নতুন করে ভাবা উচিৎ। এই শিল্পে যে পরিমাণ অকারণ প্রাণহানী, চাঁদাবাজী, জালিয়াতি, দুর্নীতি, বিচারে বাধা, আত্মসাত, ভুয়া গবেষণা, হয়রানি আর খুনের টার্গেট আছে, সেটা সম্ভবত সবচেয়ে কঠোর মাফিয়া ডনকেও লজ্জা দেবে। মার্কিন বিচার বিভাগ এ পর্যন্ত শত শত কোটি ডলার জরিমানা করেছে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে, কিন্তু তাতে তাদের দুর্নীতি তিল পরিমাণ কমেনি। কারণ, এটা তাদের কাছে ¯্রফে ব্যবসা’র খরচ। আপনি যেমনটা পানি বা বিদ্যুতের বিল দেন, তেমন।
পিটার সি গটশে একজন গবেষক এবং ডাক্তার হিসেবে ওষুধ কোম্পানিগুলোর নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করেছেন। পাশাপশি তিনি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অকল্পনীয় দুর্নীতির চেহারা তুলে ধরেছেন ‘ডেডলি মেডিসনস অ্যান্ড অর্গানাইজড ক্রাইম: হাও বিগ ফার্মা হ্যাজ করাপ্টেড হেলথকেয়ার’ বইয়ে।
ভয়াবহ বিজ্ঞান
ড. গটশে সম্পর্কে নর্ডিক কোক্রেন সেন্টার বলছে- তার ক্লিনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড আকর্ষণীয়। এখানে একটা তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। এই নর্ডিক কোক্রেন সেন্টার একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যেটি কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নেয় না। কাজেই ড. গটশে সম্পর্কে কথা বলার সময় কারো স্বার্থ রক্ষা করে কথা বলা দরকার পরে না এই প্রতিষ্ঠানটির।
ড. গটশের কাজের বড় অংশজুড়ে রয়েছে স্বর্থসংশ্লিষ্টতা, বিচার আর প্রমাণ বিশ্লেষণ। ডেডলি মেডিসনস অ্যান্ড অর্গানাইজড ক্রাইম বইটিতে ড. গটশে দেখিয়েছেন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধের আকাশছোঁয়া দাম যে আসলে গবেষণার জন্য হয় তা নয়। বরং এই দামটি বাড়াতে হয় প্রতিটি ওষুধের জন্য যে পরিমাণ রাজনৈতিক লবিয়িং, প্রচার এবং অসম্ভব হারে মুনাফা নিশ্চিত করা হয় সেই কারণে।
মঞ্চে জাদু দেখানোর বেলায় অন্যতম জনপ্রিয় একটি কৌশলকে বলা হয় স্মোক অ্যান্ড মিরর। আয়না আর অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করে শূন্যে কোনো কিছু দেখানো সম্ভব হয় এই উপায়ে, যে জিনিসটা আসলে ওখানে ন্ইে। বিচার ব্যবস্থায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর কৌশলকে এই স্মোক অ্যান্ড মিরর বলে উল্লেখ করেছেন ড. গটশে। কোনো গবেষণা করার সময় ওষুধ কোম্পানিগুলো এমনভাবে লোকজনকে বাছাই করে যে, তারা ঠিক যে ফলাফলটি পেতে চাচ্ছেন বা যে ফল বণিজ্যিকভাবে ওষুধ কোম্পানির জন্য লাভজনক হবে, সেটিই পাওয়া সম্ভব হয়। তারা ডেটা বা তথ্য নিয়ন্ত্রণ করেন, নিজেরাই বিশ্লেষণ করেন এবং পেশাদার লেখক দিয়ে রিসার্চ পেপার লিখিয়ে নেন।
এরপর এরা ওই ‘গবেষণা’ থেকে ঠিক যে তথ্যটুকু তাদের জন্য ব্যবসায়ীকভাবে লাভজনক হবে, ওইটুকুই প্রচার করেন। রোগির বা ক্রেতার স্বাস্থ্য এখানো কোনো বিষয় নয়। অনেক সময় পয়সার বিনিময়ে গবেষকদের নাম ব্যবহার করা হয় যারা আসলে ওই গবেষণা সম্পর্কে কিছ্ইু জানেন না। গবেষণার ডেটা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে কোনো জবাবও দিতে পারবেন না। গটশের মতে, সবচেয়ে প্রচলিত ওষুধগুলো সম্ভবত সবচেয়ে নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ডেটা ব্যবহারের একেকটা ফলাফল।
এসব ছাড়াও ড. গটশে তার বইয়ে দেখিয়েছেন ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক কারণেই বিপদজনক-
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপে ক্যান্সার আর হৃদরোগের পর মানবমৃত্যুর তৃতীয় বড় কারণ হলো ডাক্তারদের দেওয়া ওষুধ। এই নিহতদের অর্ধেকই ডাক্তারদের পরামর্শমতোই ওষুধ গ্রহন করেছেন। বাকী অর্ধেক ভুলভাল করেছেন, যেমন নিয়মিত ওষুধ না খাওয়া বা ওভারডোজ বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সতর্কতা উপেক্ষা করে ওষুধ খাওয়া। কিন্তু প্রথম অর্ধেকের বেলায় এমন কোনো অনিয়ম ছিল না। ওষুধ নিয়ন্ত্রণবিষয়ক কর্তৃপক্ষও গা ছাড়া। এরাও নির্ভর করে অনেক ভুয়া তথ্যের ওপর। এই তালিকায় আছে, প্রত্যেকটি ওষুধের জন্য নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, সতর্কতা, সাবধানতার বিষয়। সব ওষুধের বেলায় এইসব মনে রাখা ডাক্তারদের পক্ষে সম্ভবও নয়। ওষুধজনিত মৃত্যুর বড় কারণগুলো হলো নিস্ফলা ওষুধ নিয়ন্ত্রণ, ওষুধবিষয়ক বৈজ্ঞানিক তথ্যে জালিয়াতি, ডাক্তারদের দেওয়া ঘুষ আর ওষুধ বিপণনের ধরন যা তামাক বিপণনের মতোই ক্ষতির্ক এবং একই কারণে নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ। যতো ওষুধ গ্রহন করা হয়, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক কম ওষুধ গ্রহন করা উচিত এবং রোগির উচিত তার শরীরে যা ঢুকছে সে বিষয়ে একটু পড়লেখা করা। পড়ার উপকরণ ওষুধের সঙ্গেই দেওয়া থাকে। পাশাপাশি স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ওই ওষুধ সম্পর্কে কী বলছে সেটিও খুঁজে দেখা উচিৎ।”
এখন আপনি মনে করতেই পারেন যে ওপরের পুরো অংশটিই একটি জটিল বিষয়ে একজন অনিরপেক্ষ ব্যক্তির কথাবার্তা। তেমনটি মনে করলে আসুন দেখে নেই মেরেক কী করেছে।
খুনের টার্গেট, ভুয়া জার্নাল, হয়রানি আর টাকার খেলা
অস্ট্রেলিয়ায় ক্লাস অ্যাকশন মামলা হয়েছিল মেরেক নামে এক ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে। সহজ ভাষায়, যখন কোনো অপরাধের অসংখ্য ভুক্তভোগী থাকে আর বিচারের সময় সব ভুক্তভোগীকেই বিবেচনা করা হয় এবং রায়ও কেবল বাদী নয়, সব ভুক্তভোগীর জন্যই দেওয়া হয় তাকে বলা হয় ক্লাস অ্যাকশন মামলা। ক্লাস অ্যাকশন মামলায় বিবাদী পরাজিত হলে সাধারণত বিশাল অংকের জরিমানা গুনতে হয়।
মামলায় মেরেকের কর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া ডাক্তারদের তালিকায় দেখা যায় একেকজন ডাক্তারের নামের পাশে চিহ্নিত করা আছে ‘ঠেকাতে হবে’, ঠেকানো হয়েছে’ বা ‘সুনামহানি করতে হবে’ এমন সব নির্দেশনা। এই ডাক্তারদের অন্যায়- তারা ওই কোম্পানির ভিয়ক্স নামে একটি অষুধের বিরুদ্ধে বলেছিলেন।
আরেক ইমেইলে পাওয়া গেছে- “এদেরকে খুঁজে বের করতে হবে এবং এদের বাড়িতেই শেষ করে দিতে হবে।”
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মেডিসিনের অধ্যাপক জেমস ফ্রাইস ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে মেরেকের প্রধানের কাছে অভিযোগ করে বলেছিলেন তার কর্মীরা ওই অধ্যাপকের কিছু সহকর্মীকে হয়রানি করছেন। এরা ওই কোম্পানির ওষুধের সমালোচনা করেছিলেন।
ওই অধ্যাপক আরো বলেন, “সবচেয়ে জঘন্য বিষয় হলো ভয়ভীতি দেখানো। অন্তত আট জন ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেটরের বেলায় এমনটা ঘটেছে। আমাকেও প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হয়েছে। যদিও আমি তাদের ওষুধ সম্পর্কে কখনো কিছুই বলিনি বা লিখিনি।”
২০০১ সালেও চলছিল মেরেকের অনৈতিক কার্যকলাপ। ওই বছর তারা ‘অস্ট্রেলিয়ান জার্নাল অফ বোন অ্যান্ড জয়েন্ট মেডিসিন’ নামে ভুয়া এক জার্নাল প্রকাশ করে। এই প্রকাশনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ওই ‘ভিয়ক্স’ ওষুধের প্রচারণামূলক প্রবন্ধ ছাপানো। এতে একটি আর্টিকল ছিল যার পুরাটাই বুজরুকি। লেখক ভুয়া, একজন ডাক্তারের নাম ব্যবহার করা হয়েছে তিনি ওই প্রবন্ধ লেখেননি। এমনকি মেরেকের এক কর্মীও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে. ওই লেখায় ব্যবহৃত ডেটার পুরোটাই কাল্পনিক।
চিকিৎসা বলয়ে এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিশন। তাদের নতুন নির্দেশিকার মাধ্যমে আসলে ডাক্তারদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই মুখ বন্ধ রাখার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে কোনো ওষুধের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকারও। ওয়াশিংটনে আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিশন হলো সবচেয়ে বড় লবিয়িং গ্রুপগুলোর মধ্যে পঞ্চম যারা ¯্রফে ২০১৪ সালেই নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করতে খরচ করেছে প্রায় দুই কোটি ডলার।