ই-মেইল ব্যবহারে সতর্কতা

0
1351

রেজা সেলিম
নানা গবেষণায় দেখা গেছে, আমি আপনি যে ই-মেইল ব্যবহার করি তার পুরোপুরি নিয়ম সবাই জানি না। নিয়ম না জানার কারণে আমরা প্রায়ই খেসারত দেই। বিশেষ করে ই-মেইল এ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়া নৈমিত্তিক বিষয়। আমার ধারণা বাংলাদেশের ই-মেইল ইউজারদের প্রায় সবাই বিভিন্ন সময় নানা রকম বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। ই-মেইল খুলছে না, হ্যাং হয়ে আছে, ফাইল যোগ করা যাচ্ছে না, আপনার আইডি থেকে অন্যের কাছে টাকা চেয়ে মেইল যাচ্ছে বা নানারকম উদ্ভট খবর আপনার ই-মেইল থেকে প্রচার করা হচ্ছে ইত্যাদি। এসবের প্রতিকারে বন্ধুদের বা আইটি পরামর্শকের সহযোগিতা চাননি এমন লোকের সংখ্যা বিরল। কিন্তু আমরা যদি সচেতন হই বা সতর্ক থাকি তাহলে এসব বিড়ম্বনা এড়ানো তেমন জটিল নয়, বরং সহজ। শুধু কয়েকটি বিষয় আমাদের ভাল করে বুঝে নিতে হবে।
প্রথমেই বুঝতে হবে ই-মেইল যতই ইন্টারনেটের সব নিরাপত্তা জাল পার হয়ে যাক এটি কিন্তু যাচ্ছে একটি পোস্ট কার্ডের মতো। মাঝপথে পিয়ন বা এই চিঠি পাঠাবার প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন যে কেউ এই চিঠি বা ই-মেইল পড়তে পারেন। ফলে আপনি চিঠিতে কী লিখবেন তা নির্ভর করে আপনার প্রয়োজনের উপর। অনেকে গালাগালি বা বাজে কথা বা অসৎ উদ্দেশ্যে যদি কাউকে চিঠি লিখেন এর সকল দায়-দায়িত্ব যিনি লিখবেন তাকেই নিতে হবে। মাঝপথে, এমনকি পরবর্তী সময়েও প্রেরকের ঠিকানা জানা কোন জটিল বিষয় নয়। কারণ, আমরা যখন ইন্টারনেট ব্যবহার করি তখন আমাদের সব তথ্য, অবস্থান প্রযুক্তি নিজে থেকেই এর মধ্যে জড়িয়ে নেয়, আপনি কোন ঠিকানা দিন বা না দিন। যারা তথ্যপ্রযুক্তির খুঁটিনাটি ধারণা রাখেন তারা জানেন বা আপনি জেনে না থাকলেও জেনে রাখা ভাল যে, আমরা যখন ইন্টারনেট ব্যবহার করি বা এর সঙ্গে সংযুক্ত হই তখন আপনার ডিভাইস তা কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন যা-ই হোক তার সঙ্গে একটি ঠিকানা বা পরিচয় যুক্ত হয়ে যায়। যাকে আমরা আইপি বা ইন্টারনেট প্রোটোকল বলে থাকি। ইন্টারনেট জগতে এই আইপি পরিচয় আপনার সঙ্গে সঙ্গেই থাকবে, যা আপনি না জেনে থাকলেও যে কোন সার্চ ইঞ্জিনে যেয়ে ‘মাই আই পি’ লিখে খোঁজ করলে জেনে নিতে পারবেন।
এই আইপি ঠিকানাটি একটি সংযুক্ত কম্পিউটার (বা ‘স্মার্ট’ ডিভাইস) ইন্টারনেটে অন্য ডিভাইসের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুমতি দেয়ার জন্য ডিজাইন করা আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির আকর্ষণীয় পণ্য। আইপি ঠিকানাগুলো আক্ষরিক অর্থে কোটি কোটি ডিজিটাল ডিভাইসের অবস্থানকে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং অন্য ডিভাইস থেকে আলাদা করে দেয়ার অনুমতি দেয়। যেহেতু, একইভাবে আপনাকে মেইল থেকে চিঠি পাওয়ার জন্য নিজের একটি মেইলিং ঠিকানা দরকার, তাই দূরবর্তী কম্পিউটারকে আপনার কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও আপনার আইপি ঠিকানা প্রয়োজন হয়।
এই প্রোটোকল ইন্টারনেট জগতের যত প্রতিষ্ঠিত নিয়ম আছে তার সব মেনে চলে। ফলে এক অর্থে আপনি নিরাপদ। কারণ, যারা এই নিয়ম নিয়ন্ত্রণ করেন বা পরিচালনা করেন তাদের সব আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনেই এই কাজ করতে হয়। আবার এটা এমনও নয় যে, আইপি নিয়ে যতগুলো নিয়ম আছে তার সব আপনার জানা দরকার। ইউজারদের এসবের বিস্তারিত না জানলেও চলবে; কিন্তু আপনাকে এটুকু বুঝতে হবে যারা বিশেষজ্ঞ তারা আপনার আশপাশেই আছেন। আপনি চাইলে তাদের সাহায্য নিতে পারেন বা নিজে ইন্টারনেট সার্চ করে ভাল কোন তথ্যভান্ডার থেকে এই বিষয়ে ধারণা নিয়ে নিতে পারেন।
আপনার জন্য বরাদ্দ আইপি সম্পর্কে আপনি না জানলেও আপনাকে কিছু ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন ধরুন আপনি আপনার ডিভাইসে কাউকে কাজ করার সুযোগ দিলেন বা আপনার ইন্টারনেট কেউ ব্যবহার করছে, আপনাকে জানতে হবে যিনি আপনার ডিভাইস ব্যবহার করছেন তিনি কি কাজে তা করছেন বা আপনার ইন্টারনেট যিনি ব্যবহার করছেন তিনি বিশ্বস্ত কি-না। তিনি এমন কিছু করে বসতে পারেন যেমন কাউকে বাজে মেইল করা, বাজে ছবি পাঠানো বা কোন অসৎ উদ্দেশ্যে কিছু করলেন। এর কিছুটা দায় কিন্তু আপনার ওপরও পড়বে। কারণ সেসব কাজের সঙ্গে আপনার আইপি ঠিকানা যুক্ত আছে। যদিও বর্তমানে কারও পক্ষে অন্যের ই-মেইল বা আইডি ব্যবহার করার সুযোগ কম এবং আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা তৈরি হয়েছে যে, চট করে কেউ নিজের ই-মেইল অন্যকে ব্যবহার করতে দেয় না। এই নিয়ে অবশ্যই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
সবচেয়ে বড় বিপত্তি বাধে যখন কেউ নিজের ই-মেইল খোলা রেখে বা লগ আউট না করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে যান বা ভুলে যান। কেউ কেউ দীর্ঘ সময় তার এ্যাকাউন্ট খোলা রাখেন, তা কোনভাবেই কাম্য নয়। এতে এ্যাকাউন্ট অপব্যবহার ও হ্যাক হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আমাদের এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যাতে অন্তত নিজের জন্য ঝামেলা হলেও বারবার লগ-ইন করার কাজ নিজেই করে নেই। এতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় তো খরচ হয় না।
সতর্ক থাকতে হবে যখন কোন লটারির মেইল আসে। অনেকেই এই ফাঁদে পা দেন। না বুঝে তাদের দেয়া একটি ফরম পূরণ করে দেন, এমনকি নিজের পাসওয়ার্ড পর্যন্ত দিয়ে দেন। এসবই অসংগত বা ভুয়া। এসব ই-মেইল সঙ্গে সঙ্গে মুছে দেয়াই ভাল।
আমরা সাধারণত ই-মেইলের জন্য ইয়াহু, জি-মেইল বেছে নেই। এসব ই-মেইল ফ্রি বলে জনপ্রিয় হয়েছে বেশি। কিন্তু অফিসের কাজে এসব মেইল ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত মেইলের জন্য বরাদ্দ রাখাই ভাল। অফিসের জন্য অফিসের নিজস্ব ডোমেইন বা ইন্টারনেট আইডি ব্যবহার করা ভাল। আজকাল সব ডোমেইন হোস্টিং এজেন্সি ই-মেইল ব্যবহারের সুযোগ দেয়। এসব এ্যাকাউন্ট অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। শুধু দেখতে হবে এজেন্সি কতটা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
অনেকেই হয়ত লক্ষ্য করেছেন যে, কোন কোন ই-মেইল (সাধারণত ফ্রি এ্যাকাউন্ট থেকে) তাদের অবিকল লোগো দিয়ে আসে এই বলে যে, ‘আপনার ই-মেইল কোটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত নিচের ফরমটি পূরণ করে পাঠাবেন’ ইত্যাদি। এগুলোও দুষ্টচক্র মেইল, যাকে তথ্যপ্রযুক্তির পরিভাষায় ‘ম্যালওয়্যার’ বলা হয়। বলাই বাহুল্য, এসব মেইল আসে আপনার কম্পিউটার বা সিস্টেমে ক্ষতিকর অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে। কখনই এসব মেইলের উত্তর দিতে নেই। মনের বিভ্রান্তি দূর করতে আপনার ইন্টারনেট সেবাদানকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করাই ভাল। তবুও এরকম কোন মেইলের মধ্যে পাঠানো জরিপ জাতীয় প্রশ্নপত্রের উত্তর না দেয়া সবচেয়ে নিরাপদ। এসব সফটওয়্যার বা পদ্ধতি অবলম্বন করে অনেক সময় আপনার অজান্তে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, স্বাস্থ্যের নানা তথ্য ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হয়, যা অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। বিশেষ করে ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপত্তা আইনের আওতায় এরকম তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া অনেক সময় বিপজ্জনকও বটে। ফলে ই-মেইলে আসা এসব চটকদার বিজ্ঞাপনী মোহের ফাঁদে পা না দেয়াই উত্তম। এর কারণে নিজের অজান্তেই আপনি বড় ধরনের প্রশাসনিক বা আর্থিক ঝুঁকির মধ্যেও পড়তে পারেন।
আপনার ই-মেইলের পাসওয়ার্ড নিরাপত্তাও আপনার জন্য জরুরী। অনেকেই খুব কমন কিছু পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন, যেমন ‘১২৩৪৫৬’ ইত্যাদি ধরনের, এটা ভুল। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে সারা দুনিয়ায় এই পাসওয়ার্ডটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এরকম একটি তালিকা আপনিও ইন্টারনেটে খুঁজলে পাবেন। সে গবেষণার সুপারিশে ইন্টারনেট নিরাপত্তার প্রয়োজনে এসব কমন পাসওয়ার্ড ব্যবহার না করার পরামর্শও দেয়া হয়েছে।
আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলছি তার অন্যতম শর্ত দেশের মানুষের কাছে নিরাপদে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দেয়া। আর তা নিশ্চিত করতে আমাদের সম্মিলিত সচেতনতা জরুরী, তা ইন্টারনেট ব্যবহারে বা ই-মেইলসহ অন্যান্য সেবা পেতে যেক্ষেত্রেই হোক। ভুলের খেসারতে একদিকে যেমন দেশের বদনাম হয়, অপরদিকে ব্যবহারকারী, তাদের আত্মীয় পরিজন, সহকর্মী, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের কাছেই আমাদের বিব্রত হতে হয়। এসব সচেতনতা নিজের তাগিদেই আমাদের গড়ে তুলতে হবে, সরকার তার সহযোগিতার হাত তো বাড়িয়েই রেখেছে।