আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার

0
552

খুলনা টাইমস ডেস্কঃবিদায়ী অর্থবছরে খাদ্যপণ্যের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় রেকর্ড হয়েছে। এ সময় খাতটিতে ১৪৪ শতাংশ বেশি এলসি খোলা হয়। যা নিকট অতীতে ঘটেনি। এ ছাড়া এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিও বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। গেল অর্থবছরে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১ শতাংশের কাছাকাছি। সে হিসাবে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪ গুণ। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানি তেলের এলসি খোলার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক হারে অর্থ পাচার হচ্ছে। দুটো পরিভাষা আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িত।

সম্প্রতি এ ধরনের একটি ঘটনা চট্টগ্রাম কাস্টমসে ধরা পড়ে। তাতে দেখা যায়, ঋণপত্র খোলা হয় কাগজ আমদানির। কিন্তু চীনের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান কনটেইনারে পাঠিয়েছে ৪১০ বস্তা বালুমাটি। রহস্যজনক এ ঘটনায় অর্থ পাচার হয়েছে কি-না তা এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশ থেকে অর্থ চলে গেছে কিন্তু কোনো পণ্য আসেনি, মিথ্যা ঘোষণা কিংবা তথ্য গোপন করে ঘটছে অহরহ অর্থ পাচারের ঘটনা।

এলসি খোলা বাড়ায় এ খাতে আমদানি খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। গেল অর্থবছরে এ খাতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, অর্থ পাচার হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যে ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে রিজার্ভে বড় ধরনের ধাক্কা লাগার আশঙ্কা রয়েছে।

জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটা অসম্ভব কিছু নয়, হতে পারে। অসাধু বড় ব্যবসায়ীরা টাকা পাচারে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। অনেকে বাইরে টাকা-পয়সা রাখতে শুরু করেছেন। এ ছাড়া আইনের ফাঁকফোকর গলেও দেশের বাইরে টাকা চলে যাচ্ছে। সবার আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এটা সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৮৮৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। সেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩৪৯ কোটি ডলার। ফলে গেল অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অন্যদিকে গেল অর্থবছরের পুরো সময় রফতানি বাবদ বাংলাদেশ আয় করেছে ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৬৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। সে হিসাবে গেল অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ৬ হাজার ৯৪২ কোটি ২১ লাখ ডলার; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ৮১২ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। ফলে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৫ হাজার ১৫৩ কোটি ডলার; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ৪২৭ কোটি ২৭ লাখ ডলার। ফলে এলসি খোলায় নিষ্পত্তি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে খাদ্যপণ্যের মধ্যে চাল ও গমের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৩৬০ কোটি ৯১ লাখ ডলারের; যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৪৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। সে হিসাবে খাদ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ১৪৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে ১৬১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ এ পণ্যগুলোর এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৪ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গেল অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয় ৬৪৭ কোটি ৩৪ লাখ ডলার; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫৩০ কোটি ৮১ লাখ ডলার। সে হিসাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সময়ে পেট্রোলিয়াম তথা জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার ৫২ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার; যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৫৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ সময়ে পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি ৩২ দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৩৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৫২ কোটি ২২ লাখ ডলার।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শিল্পের কাঁচামালের আমদানি ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে যথাক্রমে ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৯৮২ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৭৭২ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। আর এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৮২২ কোটি ৪০ লাখ ডলার; যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৬২২ কোটি ডলার। এ ছাড়া এ সময়ে অন্যান্য পণ্য আমদানির এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে যথাক্রমে ৬৯ দশমিক ১০ শতাংশ ও ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ।