আইলার ১১বছর পর বন্ধ হল নলিয়ান নদীর খরস্রোত

0
1037

নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনাটাইমস :
প্রায় একযুগ আগের এক ‘মে’ মাসে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে খুলনার দাকোপ উপজেলার নলিয়ান ও শিবসা নদীর সংযোগস্থলের বাঁধ ভেঙে ৩২ নম্বর পোল্ডারের আওতায় সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়ন দুটির পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। দীর্ঘ ১১বছর পর বিস্তীর্ণ এলাকার নলিয়ান নদীর ভাঙা বাঁধের মুখ আটকানো সম্ভব হয়। পানিমুক্ত হওয়ার দিনে নদীর দুইপাড়ে সকাল থেকে সহস্রাধিক মানুষের ভীড় ছিল চোখে পড়ার মতো। নারী-পুরুষ সবার সরব উপস্থিতিতে সেখানে তৈরি হয় এক উৎসবমুখর পরিবেশের।

সোমবার দুপুরে নলিয়ান নদীর বাঁধ নির্মাণ কাজের পাশে দাঁড়িয়ে ৬৫বছর বয়সের নজির সানা নামের এক ব্যক্তি সেদিনকার ঘটনা তুলে ধরে খুলনাটাইমসকে বললেন, ভোররাত থেকেই আকাশ ভীষণ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দমকা বাতাস আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। দুপুরের একটু পর শোঁ-শোঁ আওয়াজ বাড়তে থাকে, মুহূর্তে চারিদিক অন্ধকার। প্রমত্তা শিবসা নদীর দিক থেকে প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসের পানি আছড়ে পড়ে আগে থেকে সরু হয়ে যাওয়া নলিয়ান নদীর মুখের বেড়িবাঁধে। মুহুর্তের মধ্যে বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। আমাদের ঘরবাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রায় একযুগ পর সেই ভাঙা বাঁধের মুখ আটকানো সম্ভব হল। সবাই ব্যাপক খুশি।

উপজেলার নলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা নজির সানার মতো আইলায় প্রায় সব হারানো মানুষগুলোর কন্ঠে এক ধরণের পাওয়ার আনন্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কিভাবে প্রমত্তা শিবসার তীব্র স্রোত ছোট নলিয়ান নদী দিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ হওয়া বন্ধ হয়, তা দেখতে হাজারো মানুষের সরব উপস্থিতি ছিল নলিয়ান নদীর উৎসমুখে।    সেখানে উপস্থিত থাকা সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির খুলনাটাইমসকে জানান, ১১বছর পর এলাকা পুরোপুরি পানিমুক্ত হল। পানিমুক্ত হওয়ার দিনে নদীর দুইপাড়ে সকাল থেকে হাজারো মানুষ ভীড় করে। নারী-পুরুষ সবার সরব উপস্থিতিতে সেখানে তৈরি হয় এক উৎসবমূখর পরিবেশ। শেষ দিনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের পাশাপাশি এলাকার মানুষও স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়েছে। ফলে প্রায় একযুগের আগে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বন্ধ হল নলিয়ান নদীর প্রবাহমান খরস্রোত।

তিনি বলেন, আইলার ১১ বছর পরও এলাকার প্রায় ২৫০টি পরিবার রাস্তার ওপর এখনও বাস করছে। এখন বাঁধটি পুরো ঠিক হলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো ঘরে ফিরতে পারবে। এতে নলিয়ান ও গুণারী গ্রামের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা আবার পুনস্থাপিত হল।

কয়েকজন স্থানীয় লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬০-এর দশকে পোল্ডার করার সময় শিবসার প্রশাখা নলিয়ান নদীর উৎসমুখ বাঁধ দিয়ে আটকে ফেলা হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে নলিয়ান ও শিবসা নদীর সংযোগস্থলের বাঁধ ভেঙে ৩২ নম্বর পোল্ডার জুড়ে প্লাবিত হয়। আইলায় সুতারখালী ইউনিয়নের প্রায় ১১ হাজার ও কামারখোলা ইউনিয়নের ৪ হাজারের বেশি পরিবারের ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পানি আটকে থাকে প্রায় আড়াই বছর ধরে।

দীর্ঘদিন লবণাক্ত পানি আটকে থাকায় গাছপালাও মরে যায়। তবে নলিয়ান নদীর মুখের ভাঙা বাঁধ মেরামত করা না গেলেও ভাঙা অনান্য বেড়িবাঁধ সংস্কার করার পর পানি কমতে শুরু করলে মানুষ আবার নিজেদের মতো করে ঘর বাঁধতে শুরু করে। অনেক মানুষ চলে যায় এলাকা ছেড়ে। নলিয়ান নদীর মুখ আটকে ফেলার পর এখন এলাকার মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।

আইলার কয়েক বছর পরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেড়িবাঁধ সংস্কার করার কাজ হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাঁধ ও অভ্যন্তরীণ নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়নে হাতে নেওয়া ওই প্রকল্পের নাম ‘উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প ফেজ-১ (সিইআইপি-১)’। এই প্রকল্পের আওতায় দাকোপের ৩২ নম্বর পোল্ডারে রাস্তা, নদীশাসন ও বিভিন্ন খাল খননের কাজ চলছে। ওই প্রকল্পের আওতায় নলিয়ান নদীর ওপর সংযোগবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ফার্ষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো অব হেনান ওয়াটার কনজারভেন্সি’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের কাজগুলো করছে।

বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহিত বন্ধ হওয়ায় ভীষণ খুশি সুতারখালী গ্রামের মোটরসাইকেল চালক আয়ুব আলী সানা। তিনি বলেন, নলিয়ান থেকে গুণারী যেতে হলে অনেক পথ ঘুরে যাওয়া লাগত। এখন এই বাঁধ সম্পন্ন হলে সুতারখালী হয়ে কালিনগর ও গুণারী দ্রুত যাতায়াত করা যাবে।         নলিয়ান নদীতে বাঁধ নির্মাণ কাজের স্থানীয় ঠিকাদারদের একজন শিশির কুমার বৈদ্য মুঠোফোনে বলেন, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে নদীতে এই বাঁধ নির্মাণ কাজ হাতে নেওয়া হয়। প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ জন শ্রমিক বালুভর্তি জিও ব্যাগ নদীর দুপারে ফেলতেন। ৭০০ ফুট চওড়া এবং ৪৩ বর্গফুট গভীরতার ওই নদীতে বাঁধ দিতে কমপক্ষে ১ লাখ জিও ব্যাগ লেগেছে। ব্যাগ ফেলার পর ধীরে ধীরে ভাঙনের পরিসর কমতে থাকে। এরপর গাছ দিয়ে অবকাঠামো করে তারমধ্যে ব্যাগ ফেলে পানির প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। সর্বশেষ সোমবার পানি আটকানোর দিনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ জন শ্রমিক কাজ করেছে। এলাকার মানুষের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস দেখা গেছে।

উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম খুলনাটাইমসকে বলেন, নলিয়ান নদীর মুখ আটকানো সম্ভব হয়েছে। এখন আর শিবসা নদীর পানি ভেতরে ঢুকতে পারছে না। বেড়িবাঁধের ওপর প্রকল্পের নকসা মোতাবেক বাঁধ নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের কাজের মেয়াদ বাড়ার পর চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।