শিক্ষককে পেটানো ও পানিতে ফেলার বিদ্যা

0
339

আমীন আল রশীদ
শ্যামল কান্তি ভক্ত নামে নারায়ণগঞ্জের একজন শিক্ষককে কান ধরে ওঠবোস করানোর ছবিটা নিশ্চয়ই আপনার মন থেকে মুছে যায়নি। আপনি নিশ্চয়ই আরও মনে করতে পারছেন, ওই ঘটনার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ নিজের কান ধরা ছবিতে ফেসবুকের দেয়াল ভরে ফেলেছিলেন। তারপর শ্যামল কান্তির কী হয়েছিল, সে তথ্য অনেকের জানা নেই। তবে সেই ঘটনাটি দৃশ্যপট থেকে আবছা হতে না হতেই এবার রাজশাহীতে একজন অধ্যক্ষকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছেÑযার ভিডিও ফুটেজও ফেসবুক ও গণমাধ্যমে এসেছে।
আবার এ ঘটনাটির রেশ না কাটতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে মারধরের দৃশ্যটি দেশবাসী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কল্যাণে লাইভ বা সরাসরি দেখেছে। তাদের যারা মেরেছেন, বলা হচ্ছে তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং তারা যে এই ঘটনা ঘটিয়ে, আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হটিয়ে ৯ দিন পর উপাচার্যকে নিজ কার্যালয়ে নিয়ে গেলেন, তাতে ছাত্রলীগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেও ভোলেননি ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম।
শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবোস করিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। কিন্তু রাজশাহীর অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দিয়েছেন তারই কয়েকজন ছাত্র। কিন্তু শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবোস করানোর বিচার দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, রাজশাহীর ঘটনায় ঠিক সেভাবে প্রতিবাদ চোখে পড়ছে না। অথচ নারায়ণগঞ্জের চেয়ে এই ঘটনাটি কম গুরুতর নয়। আবার জাহাঙ্গীরনগর ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া গরম। ফলে এটা বোঝা মুশকিল যে, কখন কোন ইস্যুটি ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ‘খাবেন’ বা কখন কোনটি ভাইরাল হবে।
শ্যামল কান্তি এখনও বেঁচে আছেন। তার দুর্ভাগ্য, তাকে কান ধরে ওঠবোস করানোর বিচার না হলেও বা যার নির্দেশে তাকে প্রকাশ্যে এমন নির্মম অপমান করা হয়েছিল, তিনি জাতীয় সংসদে বহাল তবিয়তে থাকলেও তারই মতো আরেকজন শিক্ষককে পুকুরে নিক্ষেপের কথা তাকে শুনতে হলো। রাজশাহীর এই ঘটনায় শ্যামল কান্তির অনুভূতি জানার জন্য তাকে ফোন দিয়েছিলাম। তিনি ঘটনাটি শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে দেখে শুধু এটুকু বললেন, ‘রাজনৈতিক বিষয়। আমার কিছু বলার নেই।’ গত জুলাই মাসে অবসরে গেছেন শ্যামল কান্তি। কিন্তু কথা বলে মনে হলো তিনি ভালো নেই।
রাজশাহীর ঘটনা ২ নভেম্বর সকালের। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দু’জন শিক্ষার্থী কম উপস্থিতির কারণে ফরম পূরণ করতে না পারায় অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদের কাছে যান এবং অনৈতিকভাবে পরীক্ষার ফরম পূরণের আবদার করেন। এ নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে তাদের বাকবিত-া হয়। এর জেরে তাকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। দেশের ইতিহাসে একজন কলেজ অধ্যক্ষকে এভাবে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেওয়ার ঘটনা সম্ভবত এটিই প্রথম। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিচার দাবিতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভও করেছেন। আশা করা যায়, এর সুষ্ঠু বিচার হবে। যেহেতু অপরাধীরা ধরা পড়েছে এবং সিসি ক্যামেরার ছবিও আছে।
যদিও শিক্ষক পেটানোর ঘটনা দেশে নতুন কিছু নয়। গত জুলাই মাসেই চট্টগ্রামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছিলেন তারই কয়েকজন ছাত্র। তার ‘অপরাধ’ ছিল, নিয়মিত ক্লাস না করায় তিনি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে দেননি। এর আগে মে মাসে পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের উচ্চতর গণিত পরীক্ষা চলার সময় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে দুই শিক্ষার্থীর পরীক্ষার খাতা কিছু সময়ের জন্য জব্দ করার ‘অপরাধে’ মাসুদুর রহমান নামে এক শিক্ষকের ওপর কলেজের গেটেই হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কয়েকদিন আগেই টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিবাদে একসঙ্গে ৫৬ জন শিক্ষক প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন।
কেন এই এই ঘটনাগুলো ঘটে বা ছাত্র নামধারী তরুণরা তাদের বাবার তুল্য শিক্ষকদের গায়ে কীভাবে হাত তুলতে পারেন বা তাকে টেনেহিঁচড়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পুকুরে ফেলে দিতে পারেন? এর খুব পরিষ্কার জবাব ছাত্র রাজনীতির নামে ক্যাম্পাসে ক্ষমতার বিস্ফোরণ ও দলীয় দাসত্ব। যে ছাত্ররা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক পরিচয় আছে। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া একজন সাধারণ ছাত্রের পক্ষে শিক্ষককে টেনেহিঁচড়ে পানিতে ফেলা তো দূরে থাক, তর্ক করারও সাহস হওয়ার কথা নয়।
জাহাঙ্গীরনগরের ভিসির দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছিল প্রায় তিন মাস ধরে। শুরু থেকেই এই আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে ভিসিপন্থী হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও মাঠে ছিলেন। কিন্তু ভিসির পদত্যাগ দাবিতে যখন একটি পক্ষ তার বাসভবনের সামনে অবস্থান নিলো, তখনই মুখোমুখি হয় দুপক্ষ। ৫ নভেম্বর সকাল থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিলো কিছু একটা হবে এবং হয়েছেও তাই। দুপুরের দিকে ভিসিপন্থীরাও তার বাসভবনের সামনে যান এবং ভিসিবিরোধীদের সাথে প্রথমে কথাকাকাটি এরপর ধাক্কাধাক্কি অতঃপর ছাত্রলীগের হামলা। পুরো বিষয়টি যে আগে থেকে ঠিক করা তা ওই দৃশ্যটি যারা টেলিভিশনে লাইভ দেখেছেন তাদের কাছে স্পষ্ট। দুটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষের চিরায়ত দৃশ্য ছিল না এটি। এখানে পরিষ্কার দেখা যায় খোদ শিক্ষকরাই মার খাচ্ছেন তাদের সন্তানতুল্য ছাত্রদের হাতে। উপাচার্য অবশ্য এই ঘটনার পরে সাংবাদিকদের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, সেখানে দাবি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের ইন্ধনে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে।
এই অভিযোগও নতুন কিছু নয়। যখনই কোথাও কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেটি যত জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুই হোক না কেন, শুরুতেই এটা বলে দেওয়া হয় যে, এটি বিএনপি-জামায়তের লোকেরা করেছে। এমনকি প্রগতিশীল বা বামপন্থী সংগঠনের লোকেরা কোনও আন্দোলন গড়ে তুললে সেখানেও বিএনপি-জামায়তে ষড়যন্ত্র খোঁজা হয়। এতে জনমনে যে প্রশ্নটি ওঠে তা হলো, দেশে বিএনপি-জামায়াত এত শক্তিশালী?
সম্প্রতি গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নাসিরউদ্দিনও তার অপকর্মের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকেও বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং সেখানেও তিনি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে এই আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তাকে সরে যেতে হয়। দেখা যাচ্ছে, খোদ শিক্ষকদের একটি অংশই ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিজেদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেন।
বছরের পর বছর ধরে আমাদের শিক্ষকরা নিজেরাই যে নিজেদের অবস্থান দুর্বল করেছেন, নানাবিধ অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, তার ভূরি ভূরি উদাহরণ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কী ধরনের অন্যায় ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত, সে বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ গণমাধ্যমে আসে। তাদের পদত্যাগ ও অপসারণের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও নিয়মিত ঘটনা। সুতরাং একজন অধ্যক্ষকে পানিতে নিক্ষেপের বিচার দাবিতে একদিকে যেমন নাগরিকদের সোচ্চার হওয়া দরকার, তেমনি কারা আমাদের শিক্ষক হচ্ছেন, তাদের কতজন শিক্ষক হওয়ার যোগ্যÑসেই প্রশ্নও তোলা উচিত।
বস্তুত মেরুদ-হীন, সুবিধাবাদী, লোভী ও দলবাজ শিক্ষকদের আশকারার কারণেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নামধারী কিছু তরুণ নিজেদের শিক্ষার্থী পরিচয় ছাপিয়ে অন্য কিছু হয়ে ওঠেন। যে কারণে তারা পিতৃতুল্য শিক্ষককে ক্লাসরুম থেকে বের করে দিতে পারেন; মারতে পারেন; টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দিতে পারেন। অর্থাৎ তাদের ক্ষমতার উৎসটি প্রথমত রাজনৈতিক দল, দ্বিতীয়ত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলে দুজন শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনও তফাৎ নেই এবং তিনি শিক্ষককে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। কিন্তু যখনই তার একটি রাজনৈতিক পরিচয় দাঁড়িয়ে যায় বা তিনি যখনই কোনও না কোনোভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে অবস্থান বা ঘোরাঘুরি করেন, তখনই তার সঙ্গে তার আরেকজন সহপাঠীর সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে আবরার ফাহাদ নামে একজন শিক্ষার্থীকে তার যে সহপাঠীরা পিটিয়ে মেরে ফেললেন, তাদের কেউ শুধুই সাধারণ শিক্ষার্থী নন। প্রত্যেকের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। ঘটনার পরে বহিষ্কার হয়েছেন বটে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয় ছিল বলেই তারা তাদের একজন সহপাঠীকে পিটিয়ে হত্যার সাহস পেয়েছিলেন। এই পরিচয় না থাকলে পিটিয়ে হত্যা তো দূরে থাক, কারো সাথে জোরে কথা বলারও সাহস তাদের হতো না। একইভাবে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ নামে একজন দর্জিকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে যারা কুপিয়ে খুন করলেন তারাও সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদেরও রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। আর এই পরিচয়টিই অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের স্পষ্ট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে এবং তাদের বেপরোয়া ও খুনিতে পরিণত করেছে।
এসব ঘটনার পরে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, থাকলেও সেটির ধরন কী হবেÑমাথাব্যথা হলেই মাথা কেটে ফেলতে হবে কিনা, ইত্যাদি বিতর্ক সামনে এসেছে। যখন এ বিষয়ে আলোচনা ওঠে তখন ঘুরেফিরে ষাট ও আশির দশকের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসও সামনে আনা হয়। কিন্তু গত তিন দশকে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির, বিশেষ করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির কী অর্জন, মূল দলের অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন আর দলীয় দাসত্ব ছাড়া প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন আর কী করেছে বা করছেÑতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে।
অনেকে ক্যাম্পাসের এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ভাবতে পছন্দ করেন এবং প্রতিটি ঘটনার পরেই অভিযুক্তদের বহিষ্কার, কখনো সখনো সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসে অভিযুক্ত ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম ও কমিটি স্থগিতও করা হয়। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের জবাবদিহি আছে বলে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যে পদ্ধতির ভেতরেই গলদ, সেখানে এরকম বহিষ্কার, স্থগিত বা গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো আড়াল করা গেলেও ক্যাম্পাসে ক্ষমতার রাজনীতির যে নগ্ন দিক, সেটি মুছে ফেলা যায় না।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর