মীনা দিবসের কিছু কথা

0
549

দীপক রায়: পৃথিবীতে ধনি রাষ্ট্রের তুলনায় দরিদ্র দেশের সংখ্যা অনেক বেশী। তারমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আর্থসামাজিক অবস্থা বড়ই করুন। আর স্বাভাবিক ভাবেই দরিদ্র সমাজে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসস্কার বিদ্যমান। এর কুপ্রভাব সবথেকে বেশী পড়েছে মেয়েদের উপর। মধ্যযুগে হিন্দু ধর্মে কন্যা শিশুকে নদীতে ফেলে দেওয়া হত, সতীদাহ প্রথা কিভাবে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় স্ত্রীকে পুড়িয়ে মেরেছে তাছাড়া আধুনিক যুগে ডাক্তারী পরিক্ষার পর কন্যা শিশুকে মায়ের গর্ভেই মেরে ফেলা হচ্ছে। এমন নির্মম এবং জঘন্ন হত্যাকান্ড যুগে যুগে হৃদয়বান মানুষদের ব্যথিত করেছে। আজও নারী শিশু এবং নারীরা ধর্ষন, খুন, বাল্য বিয়ে ও পাচারের শিকার হচ্ছে অতি সুকৌশলে।কোনো কোনো আদিবাসি সমাজে নারীরা সংসারের সব কাজই করে থাকে। ভন্ডামীর চাদরে ঢাকা এ সমাজে নারী শিশুদের নিরাপত্তার বড়ই কম।
মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ নির্ধারণ করলেও এর আগেই অনেক কন্যা শিশুকে বিবাহ দেওয়া হয়, ফলে অপরিনত বয়সে তাদের হতে হয় সংসারি মা। দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন দেশে মেয়েদের স্কুলে ভর্তির হার ছেলেদের তুলনায় ৫০% কম। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের পুষ্টির মাত্রাও কম। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মৃত্যুর হার বেশী। আজও নারী শ্রমিকদের মজুরি পুরুষের তুলনায় অনেক কম। এসব বিবেচনা করে, সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগীতা পরিষদ(সার্ক) ১৯৯০ দশককে কন্যা শিশু দশক হিসাবে ঘোষনা দেয়। এ ঘোষনার আলোকে দক্ষিণ এশিয়ার ইউনিসেফ এবং তার সহযোগীদের মিলিত উদ্যোগে গ্রহন করে মীনা কেন্দ্রীক কর্মসূচী, যা একটি প্রতিবাদী এবং গণযোগাযোগ কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের অধীনে ইউনিসেফ তৈরী করে মীনা কার্টুন, কমিক বই ও শিক্ষা উপকরণ। দক্ষিন এশিয়ার দেশসমুহে কন্যা শিশুর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মেয়ে শিশু ইসুটি আরও জোরদার করার জন্য প্রতীক হিসাবে ও ইউনিসেফ গৃহিত কার্যক্রম মীনা গণযোগাযোগ কর্মসূচীকে বেশী বেশী জনপ্রিয় করে তোলার জন্য সার্ক প্রতিবছর ২৪ সেপ্টেম্বর দিনটিকে মীনা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষনা দেয়।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের কাছে এখন মীনা অতি পরিচিত এবং জনপ্রিয় কার্টুন ছবির নাম। এ কার্টুন ছবির প্রধান চরিত্র মীনা এ অঞ্চলের মেয়ে শিশুদের প্রতীক। এ অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ীতেই খুঁজে পাওয়া যাবে মীনাকে। একটি শিশু মেয়ে মীনাকে নিয়ে কার্টুন ছবিতে তুৃলে ধরা হয়েছে মীনা পরিবারের কাহিনি। ১৩ পর্বের এ ছবিটি দেখানো হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল,পাকিস্তান ও শ্রীলংকার টেলিভিশনে। কাহিনিটি এ্যাডভেঞ্চার ও কমেডিসমৃদ্ধ। ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে এ অঞ্চলের মেয়ে শিশুদের সমস্যা। কাহিনিতে দেখানো হয়েছে কিভাবে মেয়ে শিশু এবং তার পরিবার রূপান্তর করে তাদের জীবন, সমাধান করে উন্নত করে যোগাযোগের দক্ষতা।
মীনা দক্ষিণ এশিয়ার সিমানা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে আরবি, বার্মীজ এবং চীনা ভাষাসহ ৩০ টিরও বেশী ভাষার পথ ধরে। দক্ষিণ এশিয়ার পরিবার এবং সমাজে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, বিশেষকরে অল্পবয়সি মেয়েদের দুর্দশা ঘটানো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা পুষ্টি এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কঠিন ও নির্মম সত্যের মুখোমুখি সংগ্রামী চরিত্র মীনা। মেয়েদেরও যে ক্ষমতা আছে, তাদের পছন্দ ও অ-পছন্দ আছে তা যুক্তি দিয়ে তুলে ধরে মীনা। এসব সমস্যার সমাধান এবং হাতের কাছেই তার দিক নির্দেশনা দেয় সে। মেয়েদের জীবন, মন ও চিন্তা চেতনায় ইতিবাচক মনোভাব আনয়নে অনুঘটকের কাজ করে মীনা চরিত্র।
আমাদের বাংলাদেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের প্রিয় কার্টুন মীনা। দেশের গ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষ ৬৭টি ভ্রাম্যমান ফিল্ম ইউনিটের মাধ্যমে মীনা কার্টুন দেখছে। ৪৭ হাজারেরও বেশী স্কুলে বিতরণ করা হয়েছে মীনা কমিক বই। মীনা বিষয়টি নিয়ে পাপেট শো হয়েছে এবং রেডিও জিংগেল গানও বেরিয়েছে। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচীর বাস্তবতায় অনেক এনজিও মীনা সরঞ্জাম বিতরণ করছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অনগ্রসর দেশ ও সমাজের জন্য তৈরী মীনা এখন এশিয়া ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিশ্বের সর্বত্র। মীনা এখন বড় একটি উদাহরণ. তাই মীনা এবং মীনা দিবস দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে পেয়েছে আন্তর্জাতিক মর্যাদা।
লেখক একজন সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী