দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশন সম্পন্ন

0
269

খুলনাটাইমস ডেস্ক : জনশক্তি, বিদ্যুত,জ্বালানী ও টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো জোরদার করার দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে দুই দিন ব্যাপি বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের ১৩তম যৌথ কমিশন’র (জেসি) বৈঠক বৃহস্পতিবার সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাসের প্রেক্ষিতে সৌদি আরবের বৃহৎ কোম্পানিগুলোর এখানে ব্যাপক বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়েও জেসি আলোচনা করেছে। আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মনোয়ার আহমেদ, অপর দিকে সৌদি আরবের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সেদেশের শ্রম ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপমন্ত্রী মাহির আব্দুল রহমান গসিম। ইআরডির আয়োজনে জেসির বিভিন্ন অধিবেশনে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, বিভাগ ও সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তাগণ অংশ নেন। দু’দেশের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বপূর্ণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। যৌথ কমিশন শেষে বৃহস্পতিবার এনইসি সম্মেলন কক্ষে ইআরডি সচিব ও সৌদি উপমন্ত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং পরে সমাপনি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। মনোয়ার বলেন, জেসি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন,‘ এটা আমাদের বন্ধুত ও সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা।’ তিনি জানান, সৌদি পক্ষ অনেকগুলো প্রকল্পে বিনিয়োগে সম্মত হয়েছে এবং এ ব্যাপারে শিগগিরই দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। সৌদি উপমন্ত্রী মাহির আব্দুল রহমান গসিম বলেন, তার দেশ এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। বৈঠককালে প্রতিনিধিগন দু’দেশের সর্বশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়ে তথ্য বিনিময় করেন এবং বাংলাদেশ ও সৌদি আরবর মধ্যে সহযোগিতার ফলাফল পর্যালোচনা করেন। ইআরডির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সৌদি পক্ষ ক্ষুদ্র ঋণ, নীতিমালা, ইশতেহার ও এসংক্রান্ত জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও (বিবি) এবিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিনিময়ে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ পক্ষ ক্ষুদ্র ঋণ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিষয়ে এমআরএ ও পিকেএসএফ’র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে সৌদি পক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(বিআইডিএ) সৌদি পক্ষকে নতুন বিনিয়োগ সুবিধা এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যত প্রকল্প বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানাতে সম্মত হয়েছে। সৌদি চেম্বার কাউন্সিলের আওতাধীন সৌদি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলো (এসিডব্লিউএ পাওয়ার, আর্মকো, আল-বাওয়ানী, আল-জোমিয়াহ, ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন, রেড সি গেট ওয়ে টার্মিনাল, মধু ও স্বাস্থ্য) বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছে। উভয় পক্ষই আল-বাওয়ানির ইজারা নিয়ে বেজা কর্তৃক এক হাজার একর জমি ইজারা নিয়ে আলোচনা করে। আল-বাওয়ানী গোষ্ঠী সম্ভাব্য খাতের উপযুক্ততা নির্ধারণে একটি সমীক্ষা করতে সম্মত হয়েছে। সৌদির পক্ষে জিমকো (বিএসইসির আওতাধীন একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান) এর সঙ্গে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দ্রুত করার জন্য সৌদি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছে এবং বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশি বিনিয়োগ নীতিমালার আওতায় সর্বাধিক সুযোগসুবিধা প্রদানসহ সৌদি বিনিয়োগকারীদের সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দেয়। আল জোমিয়াহ গোষ্ঠির সঙ্গে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো উন্নয়নে (৪ জি এবং ৫ জি) প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রস্তাব আলোচনা হয়েছে এবং উভয় পক্ষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুবিধাজনক খাতে আরও কাজ করতে সম্মত হয়। বাংলাদেশের সৌদি এবং বিএফআইডিসির ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন বাংলাদেশের শতভাগ রফতানিমুখী আসবাব এবং কাঠ প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় উৎপাদন ও বিপণনের কৌশলগত অংশীদারিত্বে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে মাছ-মাংস আমদানি করার ওপর সেদেশে বিদ্যমান অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ জানিয়েছে। উভয় পক্ষই সৌদি আরবে বাংলাদেশী মেডিকেল কর্মী নিয়োগ করার ব্যাপারে তাদের সদিচ্ছা প্রকাশ করেছে। তারা মেডিকেল পরামর্শদাতা, নার্স এবং ধাত্রী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতেও সম্মত হয়েছে। পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও বিচার বিভাগীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে, উভয় পক্ষই পাসপোর্ট, ওয়ার্কিং ভিসা এবং অন্যান্য ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রদান ত্বরান্বিত করতে একমত হয়েছে। সৌদি পক্ষ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উভয়পক্ষ ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং কর্মসূচী বিনিময় করার জন্য বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমী (বিএফএসএ) এবং প্রিন্স সৌদ আল ফয়সাল ইনস্টিটিউশন ফর ডিপ্লোম্যাটিক স্টাডিজ (পিএসএএফআইডিএস) এর মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার বিষয়ে আলোচনা করেছে এবং প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে সম্মত হয়েছে। উভয় পক্ষই দুই দেশের মধ্যে বিচারিক ক্ষেত্রে এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ, জালিয়াতি, এবং জালিয়াতি সংশ্লিষ্ট অপরাধ মোকাবেলায় সহযোগিতার ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে এবং আরও সহযোগিতা করার পাশাপাশি উভয় দেশে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য হালনাগাদ তথ্য বিনিময় করতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ সৌদি প্রতিনিধিদের কাছে তিনটি বিষয়ে প্রস্তাব হস্তান্তর করেছে -সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ লাভের জন্য সৌদি বিচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে অনলাইনে আবেদন জমা দেয়ার সমস্যা, আদালত থেকে মৃতের উত্তরাধিকারীদের নামে ক্ষতিপূরণের চেক প্রদান সংক্রান্ত সমস্যা এবং আদালতে মামলা দায়ের করার সমস্যা। সৌদি পক্ষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমস্যাগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে। উভয় পক্ষই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক পণ্যের বৈচিত্র্যের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। সৌদি পক্ষ সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উভয় পক্ষ বাংলাদেশী ব্যবসায়ি খাতে সুবিধাভোগীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে সৌদি এক্সপোর্ট প্রোগ্রাম (এসইপি) জোরদার করার মাধ্যমে পারস্পরিক সুবিধার বিষয়ে এবং যৌথ অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পর্কে আলোচনা করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষই উৎস দেশ, পণ্য প্যাকেজিং, প্যাকেজে তথ্য প্রদান এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়সহ উভয় দেশের শুল্ক কর্তৃপক্ষের বিধি-বিধানগুলো মেনে চলার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। সৌদি পক্ষ দুটি দেশের পর্যটন সম্পর্কিত সম্মেলন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগদান করার মাধ্যমে পর্যটন বিশেষজ্ঞ, পেশাজীবী ট্যুর অপারেটর এবং ভ্রমণ লেখক বিনিময়ে বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা করার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশ পক্ষ বিমানকে সকল দিক থেকে সৌদিয়ার সাথে সমান হিসাবে বিবেচনা করার জন্য সৌদি আরবের জেনারেল অথরিটি অব সিভিল এভিয়েশন (জিএসিএ) এর কাছে অনুরোধ করেছে। জিএসিএ উভয় পতাকাবাহী পরিবহনকে সকল ক্ষেত্রে সমান বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছে। উভয় পক্ষ পরস্পরকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল সহ বিভিন্ন শাখায় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের আরও বেশি বৃত্তি প্রদানের জন্য সৌদি আবরবের কাছে অনুরোধ করেছে। উভয় পক্ষ বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এবং সৌদি স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড মেট্রোলজি এন্ড কোয়ালিটি অরগানাইজেশনের (এসএএসও) মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার বিষয়ে একমত হয়েছে। উভয় পক্ষ ইসলামী বিষয়ের ক্ষেত্রে কর্মসূচি শেষ করতে এক সাথে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। উভয় পক্ষ বাংলাদেশে কৃষি, মৎস্য ও মৎস চাষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে আলোচনা করেছে। উভয় পক্ষ শ্রম সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটিতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ পিপিএ নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের পিপিএ কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ত্বরান্বিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলতে রাজি হয়েছে। ইএমআরডি, পেট্রোবাংলা, বিপিডিপি, আরামকো ট্রেডিং এবং এসিডাব্লিউএ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার বিকল্পগুলোর বিষয়ে আলোচনা করেছে এবং সম্মত হয়েছে যে, নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। বিএসএফআইসি এবং এসিডব্লিউএ ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ ও সৌদি প্রতিনিধিরা উভয় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনা শেষে, বাংলাদেশ ও সৌদি আরব উভয়ই দেশের প্রতিনিধিরা পারস্পরিক সহযোগিতা আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশনের ১৪ তম অধিবেশন রিয়াদে অনুষ্ঠিত হবে।