খুলনায় প্রাণ বাঁচাতে সব সময় এগিয়ে যান একদল ‘রক্তযোদ্ধা’

0
799

আজিজুর রহমান :
বছর চারেক আগের কথা। হাসপাতালে রোগির রক্তের প্রয়োজন হলেই শঙ্কা জেঁকে বসত স্বজনদের মনে, কোথায় মিলবে রক্ত। দুশ্চিন্তা আর উদ্বিগ্ন যেনো কাঁধে ভর হয়ে বসত। সংকটাপন্ন মূহুর্তে উপায়ান্তর না দেখে অনেকেই ধরণা দিতেন পেশাদার রক্তাদাতাদের কাছে। টাকা দিয়ে কেনা রক্ত রোগির শরীরে দিয়ে সাময়িক প্রয়োজন মিটলেও ভর করত আরেক দুশ্চিন্তা। রোগ সারাতে আরেক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না তো? আশার কথা, রক্ত নিয়ে দুশ্চিন্তার সময় এখন অতীত। রক্তদাতা একদল তরুণ-তরুণী সারাক্ষণ অপেক্ষায় থাকেন একটি আহবানের, ‘একজন মুমূর্ষু রোগিকে বাঁচাতে রক্তের দরকার।’ খবর পেলেই ছুটেপড়া। রোগির ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে যান হাসপাতালে। রক্ত দিয়ে উল্লাসিত হয়ে ফেরেন ঘরে।
খুলনা শহরের একদল তরুণদের এখন এটি মুখ্য কাজ। স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রথম দিকে ওই তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) গ্রুপ তৈরি করে এক হয়েছেন। ‘খুলনা ব্লাড ব্যাংক’ নামের ওই গ্রুপের তরুণেরা রক্তদানের আহবানে সাড়া দিয়ে ছুটে বেড়ান মানুষের জীবন বাঁচাতে। এমনও হয়েছে রোগির নামধাম জানেন না, রক্ত দিয়ে চলে এসেছেন। এ রকম অনলাইনভিত্তিক একটি সংগঠন দুশ্চিন্তায় ভরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে রক্তদাতা জোগাড় করে তাঁদের শঙ্কা দূর করতে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
খুলনা ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন মো. সালেহ্ উদ্দীন সবুজ শোনান তাঁদের এক হওয়ার পটভূমি। শিক্ষাজীবন শেষে নগরেই ব্যবসায় শুরু করেন সবুজ। তখন মাথায় চেপেবসে খুলনার সংকট নিরসন করে উন্নয়ন সম্ভাবনার কথা। সেভাবেই ২০১৬ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘আমাদের খুলনা’ নামের একটি ফেসবুক পেজ তৈরি করেন। এরপর ফেসবুকে কথাবার্তা। একপর্যায়ে ওই পেজে রক্ত প্রয়োজন দাবি করে মন্তব্য করেন একজন ব্যক্তি। তাতে সাড়া দেন ফারদীন ইসলাম অনিক নামের একজন তরুণ।
সবুজ বললেন, ‘আগে থেকে কারও সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সময় পেজে রক্ত প্রয়োজন দাবি করে মন্তব্য করেন অনেকেই। এতে সাড়া দিয়ে রক্ত দিতে গিয়ে পরিচয়। তারপরে রক্তদাতাদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ হতো। একটা সময় চিন্তা করলাম, নিজেদের একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। এরপর সবার সঙ্গে আলোচনা। অবশেষে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ খুলনা ব্লাড ব্যাংকের যাত্রা শুরু।’
খুলনার রক্তদাতা সংগঠনগুলোর মধ্যে খুলনা ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম বেশি বিস্তৃত। ফেসবুকে এই সংগঠনের অনুসারী (ফলোয়ার) প্রায় ১০ লাখ। তাঁরা প্রতিদিন গড়ে রক্ত দেন কমপক্ষে ৬০ ব্যাগ।
খুলনার সবখানে রক্ত দিতে যান? সবুজ বললেন, ‘খুলনা থেকে শুরু করে ঢাকা, রাজশাহী রক্ত দিতে যান আমাদের সদস্যরা। শুধু ঢাকা, রাজশাহী নয় দেশের প্রতিটি জেলায় আমরা রক্ত দিয়ে আসছি। আমাদের অনুসারী (ফলোয়ার) সব জেলায় রয়েছেন। এই কাজে কোনো ছুটির দিন নেই। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই রক্তের চাহিদা থাকে। যখন-তখন ফোন আসে। পালা করে আমাদের কেউ না কেউ সারা দিন অনলাইনে সক্রিয় থাকেন। চাহিদা পাওয়ামাত্রই তা পূরণের জন্য তৎপর হয়ে পড়েন।’
কীভাবে এত চাহিদা সামাল দেন? জানতে চাইলে মুখে হাসি টেনে গ্রুপটির ফোকাল পারসন মো. আসাদ শেখ বলেন, ‘আমাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা এখন অনেক বেশি। সামাল দেওয়া কঠিন বটে, তবে পারছি তো। কারণ, আমাদের বড় শক্তি অনুসারীরা (ফলোয়ার)। ফেসবুকে রক্তের আহবান পোস্ট করলেই অনুসারীরা যোগাযোগ শুরু করেন। এরপর আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তদাতা পৌঁছে যান রোগির কাছে। অবশ্য রোগির বিস্তারিত জেনে তারপর আমরা উদ্যোগ নিই।’ খুলনা ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন ছয়জন হলেও বর্তমানে ২০ জন রয়েছেন। এরমধ্যে ৪৬ বারের ওপরে রক্ত দিয়েছেন সৌরভ গাইন নামের একজন স্বেচ্ছাসেবী।
সৌরভ বললেন, ‘আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এই প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও আমরা মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ঈদের ছুটিতে মানুষজন স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটান। অনেকে হাসপাতালে অসুস্থ স্বজনকে রেখে বাড়িতে ঈদ করতে চলে যান। আমরা এমন রোগির পাশে দাঁড়াই। রক্তের ব্যবস্থা করে দিয়ে তাঁর সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি। অনেক সময় গভীর রাতে অনেকে রক্তের জন্য ফোন করেন। তখন রক্তদাতা সংগ্রহ করে দিতে হয়। রক্ত পাওয়ার পর রোগিকে যখন সুস্থ হতে দেখি, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।’
এ ছাড়া ১১৩ জন সহকার্যকরী ও ৫১ জন কার্যকরী সদস্য এবং ৩০ জন মডারেটর রয়েছেন ওই সংগঠনের গ্রুপে। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রথমেই সহকার্যকরী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। কর্মদক্ষতায় নির্বাচিত হন কার্যকরী সদস্য। তাঁদের রয়েছে ‘সুপার ডোনার’ নামে রক্তদাতাদের একটি তালিকা। যেখানে ৫০ হাজার সদস্য রয়েছেন। তাঁরা দেশের যেকোনো প্রান্তে গিয়ে রক্ত দিতে প্রস্তুত।
সংগঠনটির রক্তদান করা ছাড়াও শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্লাড গ্রুপিং, রক্তদানে উৎসাহিত করা ও থ্যালাসেমিয়া মুক্তির লক্ষ্যে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, অসহায় রোগীদের সাহায্য করা ও অসহায়দের মধ্যে খাদ্য সহায়তা প্রদান। ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে রক্তদানে বিশেষ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের সম্মাননা দেওয়া হয়।
গ্রুপটির সর্বপ্রথম রক্তদাতা ফারদীন ইসলাম অনিক। ২০১৬ সালের প্রথম দিকের একটি ঘটনা থেকে শুরু হয় রক্তদান। ওই পেজের একজন অনুসারী বজ্রপাতে শরীর পুড়ে গেছে এক নারীর জন্য রক্তের প্রয়োজনে মন্তব্য করেন ডুমুরিয়া থেকে। রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ। অ্যাডমিন অনিকের গ্রুপ সঙ্গে মিলে যায়। একটি কলেজে অধ্যয়নরত অনিক এই ধরনের আহবানের জন্য প্রস্তুতও ছিলেন। খবর পাওয়ার পরপর রওনা হয়ে যান খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পথে। মিনিট বিশেকের মধ্যেই পৌঁছে যান। রক্ত দিয়ে কয়েকমিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ ধরে ফিরে আসেন ঘরে।
ওই নারীর স্বজন সাব্বির আহম্মেদ মুঠোফোনে বলেন, ‘এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও রক্ত জোগাড় করতে পারেননি। আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন খুলনা ব্লাড ব্যাংকের অনিক ভাই।’
খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামের নবান্ন সরদার (৪) এক বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। এক মাস অন্তর শিশুটিকে এক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। নবান্নর বাবা পেশায় দিনমজুর। রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো মা সুলতা সরদার। খুলনা ব্লাড ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর সব কষ্ট ঘুচে গেছে তাঁর।
সুলতা সরদার বলেন, ‘খুলনা ব্লাড ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবীরা আমার ছেলেকে রক্ত সংগ্রহ করে দেন। এখন আর আমার ছেলের রক্তের জন্য মানুষের কাছে ঘুরতে হয় না। ব্লাড ব্যাংকে কয়েকদিন আগে জানিয়ে দিলেই রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যায়।’
নবান্নর মতো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত প্রায় ২০ জনকে নিয়মিত রক্তের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে খুলনা ব্লাড ব্যাংকের সদস্যরা। অ্যাডমিনরা জানান, রক্তের ব্যবস্থা করেন বিনামূল্যে। গরিব হলে অনেক সময় রক্তের ব্যাগও কিনে দেন। প্রতি মাসে অ্যাডমিনরা জনপ্রতি মাসে এক থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ করেন এই কাজে। এই টাকা তাঁরা খুশি মনে ব্যয় করেন। রক্ত দেওয়ার পর রোগির স্বজনদের মুখে যে হাসি দেখেন, তাতে মন ভরে যায়।
খুলনা সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবী এই রক্তদাতা সংগঠন এখন জেলার রোগিদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। করোনা ক্লান্তিকালে তাঁরা মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসছে। এই সংকটকালে সংগঠনের ডোনারদের করোনা পরিক্ষা করে, তারপরে রক্ত সংগ্রহ করে রোগির শরীরে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনের সময় এসব সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহজেই রক্ত পাচ্ছেন। মানুষের জীবন বাঁচাতে তরুণদের এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।’