আর চোখ মেলবে না সহকর্মী সুবীর রায়

0
565

কাজী মোতাহার রহমান বাবু
কলকাতা থেকে বুধবার সন্ধ্যায় ইথারে ইথারে প্রেস ক্লাব ও দৈনিক পূর্বাঞ্চল অফিসে ভেসে আসে শোক সংবাদটি। সহকর্মীরা খানিকক্ষণের জন্য থমকে যায় এ সংবাদ জানার পর। ক’দিন আগে সুস্থ মানুষটি চিকিৎসার জন্য কলকাতার উদ্দেশ্যে খুলনা ত্যাগ করে। সংবাদ আসে প্রিয় সহকর্মী আর ইহলোকে নেই। প্রেস ক্লাব থেকে সহকর্মীরা মুঠোফোনে একে অপরকে শোক সংবাদটি জানান। বৃহস্পতিবার স্থানীয় দৈনিকগুলোতে কমন সংবাদ ছিল গণমাধ্যম কর্মী সুবীর কুমার রায়ের ইহলোক ত্যাগ। সংবাদপত্র ও সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর তার সুহৃদরা শোকাহত হয়ে পড়ে। পাঠকের বাক রুদ্ধ হয়ে যায়। সাংবাদিক সমাজের নেতার অকাল মৃত্যু। জীবিত ছিলেন ৫৫ বছর। তার মৃত্যুর সংবাদে খুলনা প্রেস ক্লাব ও স্থানীয় পত্রিকা অফিসগুলোতে শোকের ছায়া নেমে আসে। ক্লাব ভবনে কালো ব্যানার দিয়ে শোক প্রকাশ করে খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন, স্বাধীনতা সাংবাদিক ফোরাম, বাংলাদেশ যুব ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ, পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন। শোক সন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে সংবাদপত্রের পাতায় বিবৃতি দিয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, প্রেস ক্লাব, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন, স্বাধীনতা সাংবাদিক ফোরাম, মেট্রো পলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন, রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।
দেড় যুগ খুলনার গণমাধ্যমে তার পদচারনা। ২০০১ সালে দৈনিক জন্মভূমিতে যোগদানের মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। তারপর যায়যায় দিন পত্রিকায় কাজ করেছেন একটি উল্লেখযোগ্য সময়। সর্বশেষ পূর্বাঞ্চল, বিডি নিউজ ২৪.কম ও রেডিও টু-ডে তার কর্মস্থল। পেশাগত জীবনের একটি বড় সময় রুটি-রুজি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। ২০১১-১২ সালে খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ২০১৫ ও ২০১৭ সালে প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালে প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে একটি মহৎ কাজ করেছেন। প্রেস ক্লাব চত্ত¡রে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ভাস্কর্যের কাজ সম্পন্ন করতে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। তার এ অসামান্য অবদান স্থানীয় সংবাদকর্মীরা যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে। সৃষ্টির মাঝে বেঁচে থাকবেন তিনি। পরলোকযাত্রী সুবীর রায়কে স্মরণ করে মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছেন খুলনার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন খুলনার মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুন-অর-রশিদ, নগর বিএনপি’র সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু, নগর জাতীয় পার্টির সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধু।
অনুজ প্রতীম সুবীর কুমার রায়ের পারিবারিক নাম মোহন। পড়তেন বি কে ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন ও সরকারি আযম খান কমার্স কলেজে। শিক্ষা জীবন শেষ করার পূর্বেই গণমাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত হন। সাহস নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতেন অপরাধ জগতের। তিনি ক্রাইম রিপোটার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। প্রতিদিনই ছুটতেন থানা, হাসপাতাল ও আদালত পাড়ায়। সংসারের ব্যয়ভার বহন করতে মহেশ্বরপাশা শহিদ জিয়া মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। দিনের একটি বড় সময় কাটতো শিক্ষকতা পেশায়। তারপর ইলেকট্রনিক মিডিয়া, নিউজ এজেন্সি ও সংবাদপত্রে দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। প্রেস ক্লাবে সহকর্মীদের সাথে মতবিনিময়ের ফাঁকে ফাঁকে চোখ বন্ধ করে তিনি বিশ্রাম নিতেন। একটা বড় সময় কাটতো ঘুমের মধ্যে। কখনো কখনো দুপুর গড়িয়ে বিকেলে ঘুম ভাঙত। তারপরে ছুটতেন বাসভবন, সন্ধ্যার পর দৈনিক পূর্বাঞ্চলের বার্তা কক্ষে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। সাংবাদিক আন্দোলনেও স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকেছেন সব সময়। পেশাগত জীবনের মান উন্নয়নে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও তার ব্যক্তিগত ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
কর্ম ক্লান্ত এই গণমাধ্যম কর্মী বিশ্রামের জন্য প্রায় চোখ বন্ধ করে প্রেস ক্লাবের সোফা সেটে সময় কাটাতেন। চোখ বন্ধ করে থাকাকালীন সময়ে তাকে ডাকলে সাড়া দিতেন। ডান হাতটা উঁচু করে সালাম দিতেন। তাকে সজাগ করার লক্ষে পরবর্তী ডাক দিলে বলতেন ঘুমায়নি আপনাকে সালাম দিয়েছি। গত ৬-৭ দিন যাবত সোফা সেটটিতে তাকে দেখা যাচ্ছে না। রূপসা মহা-শ্মশানে শুক্রবার চিতায় ভস্ম হয় তার নিথর দেহটি। প্রিয় সহকর্মী সুবীর রায়কে আর চোখ মেলতে দেখা যাবে না। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন চির নিদ্রায়। তার চির বিদায়ের মুহূর্তে স্মরণ করতে হয় শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় নিজেকে তিনি আকড়ে ধরেছিলেন একটি বড় সময়। সমাজ জীবনে তার এ অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার কর্মময় জীবনের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও তার আত্মার শান্তি কামনা করি।